আরাত্রিকা- by Sangeeta Mondal

আরাত্রিকা

এবং সব শেষে আমি ব্যর্থ ই হলাম। অনেক চেষ্টা করেছিলাম জানেন, একটু যদি পরিস্থিতি টা বদলানো যায়, একটু যদি চেনা মানুষ গুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে হাল ধরে থাক যায়, কিন্তু পারলাম না।
যদিও বা পারব এরকম কোনো আশা রাখিনি, ২৭ বছর ধরে নিজেকে তো চিনি, কিন্তু চেষ্টা টা চালিয়ে গিয়াছিলাম কারণ, ওই যে , ২৭ বছর ধরে নিজেকে চিনি।

এবাবা, গল্পে অনেক টা এগিয়ে গেলাম। শুরু থেকে শুরু করি?

আমি আরাত্রিকা। বাংলায় আমার নামের মানে বলতে গেলে, আমি সেই টিম টিম করে জ্বলতে থাকা প্রদীপ যেটি আমার বা আপনার মা বা দিদা কিংবা ঠাকুমা রা রোজ সন্ধে বেলায় তুলসী তলায় জ্বালিয়ে আসেন। তেমন টাই আমিও। নিজে জ্বলে, চার পাশ আলো করে রাখি।
আমি বাবা মা এর একমাত্র সন্তান। ছোট থেকে কোনও কিছুরই অভাব রাখেননি তারা। ভালো স্কুল, ভালো কলেজ, নিজের সাধ্যের থেকেও বেশি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সব সময় আমাকে। আমি পড়াশোনায় খুব যে ভালো তা নয়, তবে সঙ্গীত আমাকে বরাবর টানত ভীষণ ভাবে। মা বাবা চাইতেন আমি পড়াশোনা করে কোন রকম চাকরি করি, কিন্তু আমার না, নিয়মে বাধা বাধা জীবনের কোথা ভাবলেই কেমন দম আটকে আসতো জানেন! আমি ঠিক করেছিলাম আর যাই হোক, চাকরি করবো না কোনোদিন। আর তেমন তাই করি। বিগত ৩ বছর ধরে আমি সঙ্গীত নিয়েই বেশ আছি।

সঙ্গীত নিয়ে বেশ থাকায় মনে পড়ল, শুধু সঙ্গীত টাই আমাকে “বেশ” রেখেছে। দৈনন্দিন জীবনে হাজারো ব্যর্থতার মধ্যে আমার জীবনের সব থেকে বড় ব্যর্থতা ছিল ভালোবাসা। বলেছিলাম না, আমার মা বাবা আমাকে ছোট থেকে সব কিছুই দিয়েছেন? সব ই দিয়েছেন, ভালোবাসা টার কথা হয়তো তারা ভুলে গেছেন। আমার শরীর খারাপে আমি চিকিৎসা পেয়েছি, কিন্তু মা কে পাইনি। সাইকেল শেখার বয়সে যেই সাইকেল টা চেয়েছি সেটাই পেয়েছি, কিন্তু বাবাকে পাইনি। তাই হয়তো এই না পাওয়া ভালোবাসা খুঁজতে অন্য মানুষের দ্বারস্থ হয়েছিলাম! শুরুর দিকে আমার সাধ্যের বাইরেই ভালোবাসা পেয়ে গেছিলাম। কিন্তু শেষ টা… শেষ টা আরও সুন্দর ছিল। আসলে কি বলুন তো? ভালোবাসা টা না, জীবনে একটা জায়গা দখল করে থাকে! আর আমার জীবন? ছোট থেকে কখনও ভালোবাসা পাইনি বলে, আমি জীবনে সেই জায়গা টাই কখনও তৈরি করে উঠতে পারিনি। সারা জীবন ভালোবাসার জন্য আক্ষেপ করে তারপর যখন এক রাশ ভালোবাসা এসে আমার দরজায় কড়া নাড়ল, আমি একাকীত্বের হাত টা ছাড়তে পারলাম না! খিল দিয়ে দিলাম সেই দরজায়! ভালোবাসা তো শুধু অন্য একজন মানুষ এর সাথেই হয় না বলুন, একাকীত্বের সাথেও তো হয়! কিন্তু প্রেমের নিয়ম অনুযায়ী, আমি যাকে ভালবাসলাম, আমাকে কেও তার সাথে সুখে থাকতে দিল না!
অন্য প্রেম ক্রমাগত আমাকে হাতছানি দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকল, কিন্তু আমি তো একাকীত্বেই আসক্ত হয়ে পড়েছি! এর থেকে আমাকে বের করবে কিভাবে?

আমার মনে আছে, কাল যখন শেষ আমার তথাগত প্রেমিক এর সাথে কোথা হয়, সে শেষ বার বলেছিল, “চল না আরেকবার বসি, চল না আরেকবার ভালো বাসি”। কিন্তু আমি ভালো আছি এটা কেও কেন বুঝতে চাইছে না! কেন সবাই আমাকে সমাজের নিয়মে বাঁধতে চাইছে? কেন আমাকে আমার ভালোবাসার সাথে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না??? আমি আর পারছিলাম না জানেন তো! আয়নার সামনের মানুষ টা আমাকে কাল রাত থেকে আজ ভোর অবধি অনেক কিছু বোঝাল! কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা সাহসী , কোনটা ভীতু হওয়ার পরিচয়, অনেক কিছু। আমার সঙ্গীত ভালো লাগে, কিন্তু চার দিকের মানুষ গুলোর এত আওয়াজ আমার একদম ভালো লাগে না! ভালো লাগছে না! ওরা আমাকে মারতে চাইছে। ওরা আমাকে আটকে রাখতে চাইছে, আমাকে বেঁধে রাখতে চাইছে, কিন্তু আমি… আমি তো বাধা থাকার মতো মানুষ নয়! আমি খোলা আকাশে উড়ে বেড়ানো শঙ্খচিল।
তোমরা আমাকে বাঁধতে চাইলে তো? কষ্ট করতে হবে না! আমি নিজেই বেঁধে নিচ্ছি।
আজ ভোর বেলা আমি স্বাধীনতা বেছে নিলাম, আমি আকাশ বেছে নিলাম। পা আমি বাঁধতে দেবো না, তাই গলা টা বেধে ফেললাম!
যেই বোন টি আমাদের বাড়িতে কাজ করতে আসে, সে প্রথম সকালে ঘরে ঢুকে আমার ঝুলতে থাকা দেহ টা দেখে! ওর তো প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলার মতো অবস্থা, কিন্তু তাও কোন রকমে নিজেকে সামলে বাকি দেড় খবর দেয়, এবং আমার দেহ টা নামানো হয়।

বলেছিলাম না সঙ্গীত আমাকে বেশ রেখেছে? আমাকে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় যখন ওরা বল হরি হরি বল গাইছিল, আমার কিন্তু বেশ লাগছিল। এখন আমাকে চিতায় তোলা হয়েছে, এই সবে মুখাগ্নি করা হলো। আমার মা কাঁদছে। কিন্তু কেন? মা তো জানে। আমি তো আরাত্রিকা। নিজে জ্বলে, চার পাশ আলো করে রাখি।
……..

কিন্তু এখানেই গল্প শেষ হয় আমার। জীবন শেষ, কিন্তু গল্প নয়! এপারে এসেছিলাম আমার একাকীত্বের সাথে সুখে থাকার জন্য। কিন্তু এপারে এসে বুঝলাম, আমি একাকীত্বের একমাত্র প্রেম নই। আমার মতো হাজার হাজার প্রেমিক প্রেমিকা সব ছেড়ে চলে এসেছে আমার মতোই একাকীত্বের সাথে একা থাকার জন্য। আমি ভেবেছিলাম এপারে এসে হয়তো শান্তি পাব, তাই কাছের মানুষ, চেনা রাস্তা, পাড়ার কুকুর গুলো, আমার বাদ্যযন্ত্র সব কিছু ফেলে চলে এলাম এবং…এবং সব শেষে আমি ব্যর্থই হলাম।

 

By Sangeeta Mondal

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments