শিলংয়ের পথে- RIMA DAS

শিলংয়ের পথে

-রিমা দাস

আমাদের সকলের প্রতিদিন এর জীবনে একটা নির্দিষ্ট পঞ্জিকা থাকে, যাকে বলে দিনপঞ্জিকা বা দিনলিপি| কচি থেকে বুড়ো সকলেই এই দিনলিপি নামক জালের মধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো| সারাদিনের এই নিয়ম থেকে মাঝে মধ্যেই একটু অনিয়মে যেতে আমাদের সকলেরই ইচ্ছে করে, তা সে ক্ষনিকের জন্য হোক বা একটু দীর্ঘ সময়ের জন্য| এই দীর্ঘসময়ের জন্য মুক্তির স্বাদ নিতে আমরা হারিয়ে যেতে চাই প্রকৃতির কোলে. পাহাড় হোক বা সমুদ্র বা অন্য কোথাও| এভাবেই একদিন বেরিয়ে পড়লাম এক অভূতপূর্ব আনন্দের স্বাদ নিতে, শান্তির খোঁজে পাহাড়ের দেশে|

উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্য মেঘালয়| একসময় এটি আসামের অন্তর্গত ছিল| পরবর্তীকালে, 1972 এ গারো, খাসি এবং জয়ন্তী এই তিন জেলা মিলে মেঘালয় আলাদা রাজ্যের স্বীকৃতি পায়| এই খাসি পাহাড়ের পূর্বভাগে অবস্থিত শিলং, আমাদের গন্তব্য| একে “Scotland of East” ও বলা হয়| গৌহাটি বিমানবন্দরে যখন নামলাম তখন দুপুর প্রায় 3 এ| লাঞ্চ সেরে আমরা শিলং এর দিকে যেতে যেতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলো| তার সাথে ঠান্ডাও বাড়তে লাগলো| ডিনামাইট বিস্ফোরণ করে রাস্তা প্রশস্ত করার কাজে আমাদের গাড়ি খানিক আটকে যাওয়াতে আমাদের বেশ দেরি হলে গেল| অন্ধকার যত ঘন হতে থাকলো দূরে পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট আলো বুঝিয়ে দিলো যে আমরা, আমাদের গন্তব্যের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি| আমরা এসে উঠলাম NEHU গেস্ট হাউসে| এটি মূলতঃ North East Hill University -র ক্যাম্পাস| সারাদিনের প্রচুর ধকল গেছে,তাই ডিনার সেরে বিছানায় শুতে শুতেই ঘুমে চোখ বুজে এলো| পরদিন সকালে পাখির কলতান এ ঘুম ভাঙতেই জানলা দিয়ে বাইরে চোখ পড়লো| দেখলাম গেস্ট হাউসের পেছনের দিকে জমিটা ধাপে ধাপে নেমে গেছে নিচের দিকে| তার চারিদিকে শুধু পাইন গাছের সারি আর নির্জন নিরালা দূষণ বিহীন পরিবেশ| ব্রেকফাস্ট সেরে 9 টা নাগাদ আমরা বেরিয়ে পড়লাম| আজ আমাদের গন্তব্য Sohra, যার প্রচলিত নাম চেরাপুঞ্জি| এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকা| নীল আকাশ মাথায় করে যাত্রা শুরু করলেও যতই চেরাপুঞ্জি -র দিকে এগোতে থাকলাম আকাশ জুড়ে কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো এবং তার সাথে শুরু হলো ভীষণ বৃষ্টি|

প্রথমেই আমরা গেলাম Duan Sang Syieg view point এ| এখানে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে চারিদিকে পাহাড় আর সবুজে ঘেরা এই উপত্যকাটির স্বর্গীয় সৌন্দর্য্য উপভোগ করে আমরা এগিয়ে চললাম| চেরাপুঞ্জির প্রধান আকর্ষণ হলো এখানে অবস্থিত WaterFalls বা জলপ্রপাত গুলো| তার মধ্যে অন্যতম একটি Nohkalikai Waterfalls. উচ্চতা 340 মিটার| এটি ভারতের চতুর্থ দীর্ঘতম জলপ্রপাত|

Nohkalikai-Waterfalls

Nohkalikai Waterfalls

এখন থেকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে Mawsmai cave. এটি একটি প্রাকৃতিক গুহা| 150mt দীর্ঘ এই গুহাটি প্রবেশ প্রান্তটি যথেষ্ট চওড়া হলেও ভিতরে ক্রমশ সরু হয়ে গেছে| গুহার ভেতরের আলো-আঁধারির খেলা আর চারিদিক থেকে চুঁয়ে চুঁয়ে পড়া জল সবে মিলে যেন এক রোমাঞ্চের সৃষ্টি করেছে| এভাবেই হাতড়ে হাতড়ে চলে গুহার প্রায় মাঝখানে এসে পৌঁছলাম এবং একটি 3-3 1/2 ফুট অংশ দিয়ে শরীর টাকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে নিয়ে বেরিয়ে এসে দেখলাম গুহার ওপরের একটা ফাঁকা অংশ দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ আমরা বাইরে পৌঁছে গেছি|

Mawsmai-cave

Mawsmai cave

এরপর আমরা গেলাম 7 Sister falls বা Mawsmai Waterfalls-এ| এই জলপ্রপাতটি সাতটি ভাগে ভাগ হয়ে নেমে এসেছে পাহাড়ের বুক বেয়ে| বিশেষত বর্ষাকালেই এটির জলের পরিমান বেশি থাকে| এখান থেকে বেশ খানিকটা ড্রাইভ করে গিয়ে যে জায়গাটায় আমরা পৌঁছলাম সেটি বাংলাদেশের সিলেট সীমান্তের কাছাকাছি, আর এখানেই আছে Kho-ramhah বা Pillar Rock.এটি একটি গম্বুজ আকৃতির পাহাড় বা বড়ো মাপের পাথরও বলা যেতে পারে| যেটি খানিক টা শিবলিঙ্গ এর মতো দেখতে| কিন্তু প্রচলিত মানুষ দের মতানুযায়ী এটি একটি দৈত্যাকার খাসি বাস্কেটের জীবাশ্ম| পরন্ত বিকেলে পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে একপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া তীব্র জলের ধারা আর অন্যপাশে দুই দেশের মেলবন্ধন, মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখে উঠে পড়লাম গাড়িতে| সেদিনকার মতো আমাদের ঘোরাঘুরি তে দাড়ি টেনে আমরা ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে|

পরের দিন আমাদের গন্তব্য শিলং পাহাড় থেকে প্রায় 90km দূরে অবস্থিত একটি গ্রামে| এই গ্রামটির নাম Riwai Village বা Mawlynnong| আমাদের গাড়ি পাহাড়ের বাঁক ঘুরে ঘুরে সমতলে নেমে প্রায় 21/2 hr. চলার পর আমার পৌঁছলাম আমাদের গন্তব্যে| গ্রামের প্রতিটা রাস্তা বাঁধানো এবং অত্যন্ত পরিষ্কার| এই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে গ্রামের লোকজন এমনকি ছোট ছেলেমেয়েরাও প্রতিনিয়ত সাফাই করছে| কিছুটা দূরে দূরেই খাসি বাস্কেট ও বসানো আছে| এই পরিছন্নতার জন্যই 2013 সালে এই গ্রামটি ‘Asia’s cleanest Village’ এর তকমা পায়| এছাড়াও এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই স্বাক্ষর এবং পর্যটকদের সাথে তাদের আলাপ চারিতার মাধ্যম ইংরেজি ভাষা| এই গ্রামের আর এক অন্যতম আকর্ষণ হলো ‘Jinkieng Jri’ অর্থাৎ ‘Living Root Bridge’. এটি একটি প্রাকৃতিক সেতু| গ্রামের ভেতর দিয়ে গিয়ে পাথরের ধাপ কাটা, শ্যাওলা ধরা রাস্তা দিয়ে খুব সাবধানে নেমে গেলাম সেই প্রাকৃতিক সেতুর দিকে| সেতুর নিচ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলেছে ঝর্ণার জল| জলে পা দিতে গেলে এই সেতু দিয়ে পার হতেই হবে| শিকড়ে শিকড়ে জড়িয়ে ধরে কত বছর ধরে যে এই সেতু এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে তা আমরা অনেকেই হয়তো জানিনা| স্থানীয় কিছু দোকানিদের থেকে জানতে পারলাম প্রায় 100 বছর পুরোনো এই সেতু|

Living-Root-Bridge

Living Root Bridge

এইসব জায়গা ছাড়াও শিলং দেখার মতো আরো অনেক সুন্দর জায়গা আছে| যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘শিলং পিক’ যেখান থেকে পুরো শিলং শহর টাকে একনজরে দেখা যায়| এখানে ঢুকতে গেলে ID prove সাথে থাকা জরুরি| এছাড়া আছে ‘Balancing Rock’, ‘Tiger Falls’, ‘Ward’s Lake’, ‘Golf Ground’, ‘Air Force Museum’. ‘Air Force Museum’ – এ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ বিমান রাখা আছে যা কোনো একসময় ব্যবহৃত হয়েছিল, রাখা আছে মিসাইল, নানারকম অস্ত্রশস্ত্র এবং আরো অনেক কিছু|

অবশেষে আমাদের ফেরার দিন চলে এলো| মনটা যদিও এই জায়গা ছেড়ে যেতে চাইলনা| তবু ফিরতে তো হবেই.তাই একরাশ স্মৃতি আর শান্তি নিয়ে ফিরে এলাম আবার পুরোনো দিনপঞ্জিকার ধারায়| তবে মনটা মাঝে মাঝেই চলে যায় সেই সব জায়গা গুলোতে, তাই আজ আরও একবার এই কলমের হাত ধরে ঘুরে এলাম ‘শিলংয়ের পথে’|

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments