অন্য পূজো
-পারভীন হাসান
অন্ধকার ঘরে জানালার পাশে দাঁড়িয়েছিল পিনটু, সদ্য ভোর হয়েছে ; আজ খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়েছে | মনটা ভালো নেই তার, সে এবার কার সাথে খেলবে? পলটুটাও চলে গেলো, কত মজা তার! নতুন জামা, নতুন খেলনা সব পাবে – আর সে? “ধুর! আমার কেন বাবা-মা নেই?” বলেই রাগে বলটাকে জোরে একটা লাথি মারল | ঝন্ঝন্ করে স্টিলের খালি গ্লাসটা মেঝেতে পড়ে গেলো |
“কি হলো পিনটু? কিসের আওয়াজ?” দাদু বাইরে থেকে চিৎকার করে বলে উঠলো |
“কিছু না দাদু | আমি বল খেলছি |”
“তুমি উঠে গেছ এত সকালে? ঘরে খেলো না, যাও বাইরে গিয়ে খেলবে”, দাদু ঘরে ঢুকে বললো |
এই দাদুর কাছেই পিনটু থাকে, দাদু সবার দেখাশোনা করে তার মতো যারা এখানে আছে | তবে সে রাতে দাদুর কাছেই থাকে | পিনটু দাদুর কথা শুনে বলটাকে নিয়ে চুপচাপ খাটের ওপর বসলো | দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে |
“কি হল পিনটু? কি হয়েছে?” দাদু এসে পিন্টুর মাথায় হাত বোলালো |
কাঁদতে কাঁদতে পিনটু দাদুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “দাদু আমার মা কোথায়? বাবা কোথায়? আমাকে কেন তারা নিয়ে যাই না? কেন তারা নতুন জামা, খেলনা দেয় না? পলটুও ওর বাবা-মা পেয়ে গেলো, কত মজা ওর! আমাকে কেন কেও নিতে আসে না?”
দাদু মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “আমি তো আছি তোমার কাছে, আমি তোমার সব | বাবা-মা দুটোই; আর মায়ের জন্য যদি খুব মন খারাপ করে তাহলে দূর্গা মা কে মা বলবে, উনি সবার মা | এবার যাও তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও | আজ অনেক দাদা-দিদি আসবে, সবার জন্য খেলনা আনবে | ঠাকুর দেখাতেও নিয়ে যাবে |”
পিনটু খুশি হয়ে দাদুর দিকে তাকিয়ে হেসে বলটাকে নিয়ে লাফাতে লাফাতে বাইরে চলে গেলো | দাদুর চোখটা ছলছল করে উঠলো, এই বাচ্চাটাকে সে একটা হাসপাতালের বাইরের ডাস্টবিন থেকে তুলে নিয়ে এসেছিলো | বড় মায়া বাচ্চাটার মুখে, সেই থেকে এই হোমে বাচ্চাটার আশ্রয় |
বেলা দশটা নাগাদ হোমের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো | পিনটু ছুট্টে গিয়ে দেখলো গেটের কাছে কতগুলো দাদা-দিদি এসেছে, বড়োবড়ো প্যাকেট নামাচ্ছে গাড়ি থেকে | ভেতরে গিয়ে দাদুকে বললো, “দাদু! দাদু! অনেক দাদা-দিদি এসেছে, বড়োবড়ো প্যাকেটে কিসব এনেছে! চলো চলো দেখবে চলো!”, বলেই আবার ছুটে বাইরে চলে গেলো |
দাদু বাইরে বেরিয়ে আসতেই এক বছর তিরিশের ভদ্রমহিলা হাত জোড় করে নমস্কার করে বললো, “আমার নাম সুনিতা | আমরা KEEP SMILING NGO থেকে এসেছি | রনিতাদি আছেন?”
“আসুন” বলে দাদু সুনিতাকে রনিতাদির অফিসঘরের দিকে নিয়ে গেল |
রনিতা সরকার এই হোমটি পরিচালনা করেন | রনিতার অফিসে ঢুকে সুনিতা একটু হেসে একটা ছোট্ট নমস্কার সেরে বললো, “রনিতাদি, আপনার সাথে আগেই কথা হয়ে গেছে টেলিফোনে | তাই আর কথা না বাড়িয়ে বাচ্চাদের জিনিসগুলো তাড়াতাড়ি দিয়ে যেতে চাই | আজ পঞ্চমী, অনেক জায়গায় এখনো যেতে হবে, বুঝতেই পারছেন |”
রনিতা হেসে বললো , “হ্যা নিশ্চয়! দাদু আপনাদের বাচ্চাদের কাছে নিয়ে যাবেন |”
সুনিতা দাদুর সাথে বাচ্চাদের কাছে চলে গেলো | জনা তিরিশ অনাথ বাচ্চা এই হোমটিতে | সুনিতা আর তার দলবল ব্যস্ত হয়ে গেলো জামাকাপড়, খেলনা দিতে | এমন সময় একটা ছোট্ট টান পড়লো সুনিতার ওড়নায়, তাকিয়ে দেখলো একটা বছর ছয়েকের বাচ্চা হাতে একটা বল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে | বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সে এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠলো | বাচ্চাটার চেহারার সাথে কার যেন খুব মিল |
বাচ্চাটা বললো, “দিদি আমাকে কোন জামাটা দেবে?”
সুনিতা বাচ্চাটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, “তোমার নাম কি?”
“পিনটু! আমাকে কোন জামাটা দেবে?” বাচ্চাটা আবার বলে উঠলো |
সুনিতা একটু হেসে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে একটা প্যাকেট দিয়ে বললো, “এই জামাটা তোমার জন্য |”
পিনটু প্যাকেট নিয়ে নাচতে নাচতে দাদুর কাছে গিয়ে বললো, “দাদু ! এই দেখো! আমার নতুন জামা! এই জামা পরে আমি ঠাকুর দেখতে যাবো |”
দাদু সুনিতার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি ওকে নিয়ে এসেছিলাম | ডাস্টবিনে কেও ফেলে রেখে গিয়েছিল | বড্ডো ন্যাওটা আমার |”
সুনিতা বললো, “আপনাদের এখানে adoption হয় না ? বাচ্চাটাকে কেও adopt করেনি?”
“হয় তো! কিন্তু ওকে এখনো কেও নেয়নি | ওর বন্ধু পলটু চলে গেছে বলে আজ সকাল থেকে খুব মন খারাপ ছিল ওর | এখন দেখুন জামা পেয়ে কেমন খুশি হয়ে খেলে বেড়াচ্ছে”, দাদা হেসে উঠলো |
আজ ষষ্ঠী! কাল সারারাত সুনিতা ঘুমোতে পারেনি | ভোর রাতে ইজিচেয়ারে বসলো সে | পিন্টুর মুখটা বারবার তার চোখে ভাসছে | কেন এত চেনা লাগছে পিনটুকে ? কার সাথে মিল ওর? তার নিজের আর কোনোদিন বাচ্চা হবে না বলে কি ও পিন্টুর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে? চোখ বন্ধ করে জীবনের ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গেল | রাহুলের সাথে কাটানো ছেলেবেলা, বড় হয়ে প্রেম, বিয়ে, তাদের মৃত সন্তান, রাহুলের আকসিডেন্টে মৃত্যু – সব কিছু মনে পড়তে লাগলো | রাহুলের সাথে কাটানো ছেলেবেলা, প্রেম, বিয়ে বাদ দিয়ে বাকি সবকিছুই তার জীবনে অভিশপ্ত রাতের মতোই কালো | আজ সে একা | নিজেকে একটা NGO-র সাথে জড়িয়ে অনাথ বাচ্চাদের সাহায্য করে জীবনের একাকিত্ব কাটাচ্ছে | এইসব ভাবতে ভাবতে আধোঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল | স্বপ্নে দেখলো রাহুলের সাথে সে এখনো স্কুলের মাঠে খেলছে, পিনটু বলটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সবকিছু যেন কেমন আলো-আঁধারী | এমন সময় হঠাৎ করে অ্যালার্ম ঘড়িটা বেজে উঠলো | ঘুমটা ভেঙে হঠাৎ করে মুখ ফুটে বলে উঠলো, “রাহুল!” তাড়াতাড়ি লাইটটা জ্বেলে আলমারিটা খুললো, অনেক খোঁজার পর একটা পুরানো ফটো অ্যালবাম পেলো সুনিতা | সেখানে তার আর রাহুলের স্কুল লাইফের কিছু ছবি আছে | একটার পর একটা ছবি দেখতে লাগলো, রাহুলের ছবি ; পিন্টুর চেহারা আর রাহুলের ছোটবেলার চেহারার একটা অদভুত মিল | খুব ভাবনায় পড়ে গেল সুনিতা | এমন কি করে হয়? পিনটু তার বাচ্চা নয় তো? তাই বা কি করে হয়? পিন্টুর বয়স এখন ছয় আর সে মা হয়েছিল চার বছর আগে | না এটা সম্ভব নয় | এদিক ওদিক পায়চারি করে সে পূজাকে একটা ফোন করল | পূজা তার বেস্ট ফ্রেন্ড, সে সব কিছুই পূজাকে বলল | পূজা শুনে হেসে বলল, “পুনর্জন্মের কেস নয়তো রে?” সুনিতা কিছু না বলে ফোনটা রেখে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো | জীবনে এতো ঝড় যাওয়ার পরেও কোনোদিন তার নিজেকে দুর্বল মনে হয়নি | মৃত সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেও কখনো adoption এর কথা ভাবেনি | কিন্তু কি জানি! পিনটুকে দেখার পর তার ওপর একটা দুর্বলতা মনে তৈরী হয়েছে |
বেলা দশটা বাজতেই সুনিতা একটা ফোন করলো, “হ্যালো রনিতাদি! সুনিতা বলছি KEEP SMILING থেকে | একবার আসতে চাই | একটু জরুরি কথা ছিল |”
ফোনটা রেখে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো সুনিতা |
ষষ্ঠীর সন্ধে, মায়ের আরাধনায় মেতে উঠেছে গোটা শহর | গাড়িটা পার্কিং এরিয়াতে রেখে সুনিতা দেখলো তাদের NGO-র বাসটা দাঁড়িয়ে আছে | বাস থেকে নামল পিনটু, সুনিতার দেওয়া জামাটা পড়েছে সে | লাইন দিয়ে সুনিতা আর ওর দলবল বাচ্চাদের নিয়ে গেলো পূজো মণ্ডপে | সুনিতা কাছে এসে পিন্টুর হাতটা ধরলো, ঠাকুরের সামনে এসে দাঁড়ালো তারা | দূর্গাঠাকুরের সামনে হঠাৎ চিৎকার করে পিনটু বলে উঠল, “মা দেখো ! আমি নতুন জামা পরে এসেছি!”
খুশিতে ঝলমলে পিন্টুর মুখটা দেখলো সুনিতা, আলতো করে পিঠের ওপর হাতটা রেখে বলল, “আজ থেকে দূর্গাঠাকুর শুধু তোমার মা নয়, আমিও তোমার মা |”