স্থান : মেদিনীপুর –এর এক “old age home “। নাম : “নিরালা“।
আজ বছর ৩ হলো মালতির ঠাঁয় হয়েছে এই “নিরালায়“। ঠিক ৩ বছর আগে রক্তিম তাকে রেখে দিয়ে গেছিলো এই “নিরালায়“। আজও মনে পরে সেই দিনগুলো , কাঁকুড়গাছি তে , তার শশুর এর ভিটে তে তার শেষ দিন ছিল সেদিন । বিয়ে হবার পর থেকেই শশুর এর ভিটে তেই তার দিনগুলো কেটেছিল স্বামী শশুর শাশুড়ি ননদ দেবর নিয়ে । তারপর আসে “রক্তিম“, সবার আদরের “বাবাই“। কালক্রমে একে একে বিদায় নেয় সবাই । ননদ চলে যায় শশুরবাড়ি , দেবর বিদেশে । বৃদ্ধ শশুর শাশুড়ি প্রয়াত হন । তারপর অমল ও চলে যায় মালতি কে এক রেখে দিয়ে । নিজের বয়সের যথার্থতা প্রমান করতে , আর মা এর একাকিত্ব কাটানোর সঙ্গী পাওয়া যাবে ভেবে রক্তিম বিয়ে তে মত দেয় । বাড়িতে আসে “সম্পূর্ণা“, রূপে, গুনে একশো তে একশো পাবার মতো মেয়ে । বাড়িতে খুশির ঝিলিক দিল সেদিন , মালতির চোখে ছিল আনন্দের জল আর বুক ভরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ।
শশুর এর ভিটের কার্নিশ গুলো ভাঙতে শুরু করে । দেখা দেয় ফাটল দেওয়াল গুলোয় । বর্ষাকালে ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ে । সম্পূর্ণা ও রক্তিম দুজন ই এখন IT সেক্টর এ কর্মরত । বাড়ির দিকে চোখ রাখার সময় তাদের নেই । কিন্তু মনে আছে অসহিষ্ণুতা । তাদের status টা ঠিক ভাবে maintain হচ্ছে না । তাদের মনের মধ্যে আপ্রাণ একটি চেষ্টা চলছে , নতুন “আশ্রয় ” খোঁজার ।
বছর ২ ঘুরতে না ঘুরতেই সম্পূর্ণা আর রক্তিম এর জীবনে আসে “আঁখি“, তাদের একমাত্র মেয়ে । আর তার সাথে “আশ্রয়” এর তাগিদ টা জোরদার হয়ে ওঠে ।
মালতির চোখ দুটো আবার চিকচিক করে উঠলো খুশিতে, দু হাতে ফুটফুটে রাজকন্যা কে জড়িয়ে ধরে ।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রক্তিম আর সম্পূর্ণার “তাগিদ” “পরিপূর্ণতা” লাভ করল । Newtown এ বিলাসবহুল দুই কামরার ফ্ল্যাট , সাথে open terrace , দাম মাত্র ৬০ লক্ষ টাকা । উপায় একটাই , পৈতৃক ভিটে কে জলাঞ্জলি দিয়ে আত্মসুখ চরিতার্থ করা । এবারেও যৌথ “প্রয়াস” “পরিপূর্ণতা” লাভ করল । বাপের ভিটে বিক্রি করে রক্তিম, সম্পূর্ণা আর আঁখি গিয়ে উঠলো বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে আর “প্রয়াস” এর “পরিণাম ” স্বরূপ মালতির “আশ্রয়” এখন “নিরালা“।
স্থান : Newtown এর Mega City Complex এর ফ্ল্যাটের ড্রয়িং রুম ।
আখিঁ–র সকাল থেকেই খুব মন খারাপ, কিচ্ছু ভালো লাগছে না । আজ আঁখির স্কুল ছুটি ছিল । আজ তো কালীপুজো , বাঙালিদের দীপাবলি । সকাল বেলায় mummy papa যখন চলে যাচ্ছিল, অনেক বায়না করেছিল সে , যাতে তারা আজ তাকে একা ছেড়ে না যায় । কিন্তু কেউ কোনো কথা শোনেনি । জলদি ফিরে আসবে এই বলে তারা আঁখি কে রুপা–র কাছে রেখে চলে যায় । রুপা হচ্ছে আঁখি–র আয়া, আঁখি–র অত্যন্ত কাছের “রুপা মাসি “। সারাদিন কত গল্প করে সে , কত খেলা খেলে “রুপা মাসির” কাছে । কিন্তু আজ তো রুপা মাসি ও চলে গেছে বিকেলবেলায়, papa কে আগে থেকে বলে রেখেছিলো । তার বাড়িতে নাকি আজ কালীপুজো । রুপা মাসি তার ছেলে মেয়ে নাতি নাতনির সাথে আজকের দিন টা কাটাবে, সবাই মিলে একসাথে প্রদীপ, আতসবাজি জ্বালাবে । আঁখির মন তা ডুকরে ওঠে, একা একা বসে খুব কাঁদে সে । উৎসব এর দিনেও mummy papa র সময় হয়ে ওঠে না তার সাথে একটু আনন্দ করার, তার সাথে সময় কাটানোর, কেউ তার সাথে প্রদীপ , আতসবাজি জ্বালায় না । papa –র কাছে শোনা, papa যখন ছোট ছিল দাদু ঠাকুমা অনেক আতসবাজি কিনে আনতো , আর papa দাদু ঠাকুমা –র সাথে সেসব নিয়ে ছাদে চলে যেত , সেগুলো সব জ্বালানো হতো । অনেক মজা করতো সবাই । “আঁখি“-র তো কেউ নেই, সে যে আজ বড়ো একা। এই ভেবে কাঁদতে কাঁদতে সে ঘুমিয়ে পড়ে ।
স্থান : Sector – v এর ব্যাস্ততম office
রক্তিম এর কিছুতেই কাজে মন বসছে না । একে তো শনিবার , তার উপর কালীপুজো । গত বছর কালীপুজোর দিন ছুটি ছিল । এই বছর–ই কিরকম যেন সব ওলোটপালোট হয়ে গেল । “আঁখির” কান্না ভরা মুখ টা সারাদিন খুব মনে পড়ছে । ওইটুকু বাচ্ছা মেয়ে , আর তার আবদার গুলো মেটাতে পারছে না, পিতা হিসাবে নিজেকে খুব নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে রক্তিম–এর । নিজের ছোটবেলা টা মনে পড়ে যাচ্ছে । বাবা মা–র কাছে কোনো কিছু আবদার করা মাত্রই সে সেটা পেয়ে যেত । স্বল্প আয় এর সংসার–এ , সব কিছু সামলেও তার বাবা তার কোনো কিছুর অভাব বোধ হতে দেয়নি । নিজের জন্য পুজোতে নতুন জামাকাপড় না কিনেও, ছেলের সব বায়নাক্কা মিটিয়েছে , আর দিয়েছে অফুরন্ত সময় । সেই সময় টা কে সদ্ব্যবহার করে শুনেছে তার সমস্ত ইচ্ছে , আর পূরণ করেছে যথাসাধ্য ।
ছোটবেলার কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ৬.৩০ টা বেজে গেছে খেয়াল–ই করেনি রক্তিম । সম্পুর্না কে skype এ ping করে বেরোতে বলল। আজ তারা একসাথে বাড়ি ফিরবে ।
স্থান : নির্বিশেষে , সময় : সন্ধে ৭ টা
সারাদিন এর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রক্তিম আর সম্পুর্না যখন তাদের flat এ প্রবেশ করল, দেখল আঁখি সোফা তে ঘুমাচ্ছে । আলতো করে একটি সুইচ–এ চাপ দিলো রক্তিম, পুরো ঘর আর terrace টা টুনিলাইট–এর আলোয় ভরে উঠলো । আঁখি–র ঘুম ভেঙে গেলো । ঘুম থেকে উঠে এতো আলো দেখে সে অবাক । চুপচাপ বসে রইলো সে । ঠিক সেই সময়ই “নিরালা“-র বারান্দাতে সবকটা প্রদীপ–এর সলতে–তে একসাথে আগুন জ্বালানো হল । চার বছর বয়সী আর পঁচাত্তর বছর বয়সী দুই নারীর চোখের জলে সেই আলোকের ঝিকিমিকি খুব স্পষ্ট, অভিমানি ও একান্ত ব্যক্তিগত ।