পারভীন হাসান
Day: 24 December, 2015
অফিস থেকে ফিরে এসে ক্লান্ত শরীরটাকে সোফায় এলিয়ে দিল পালক | যাক, কাল থেকে Christmas এর একটা লম্বা ছুটি পাওয়া গেছে | সময় নিয়ে ঘরটা একটু পরিষ্কার করতে হবে | যা ব্যস্ততা গেলো কদিন, নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে একটু চোখ বুজলো সে | কতক্ষন ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না, চোখ খুলে দেখে অরিত্র ওর জন্য কফি বানিয়ে এনেছে, সেন্টার টেবিলের ওপর কাপটা রাখা আছে |
অরিত্র আর পালক দুজনেই চাকুরীজীবি, চরম ব্যস্ততার মধ্যে কাটে দুজনের জীবন | আগামী কাল থেকে Christmas এর ছুটি পড়ায় আজ একটু আগেই ফিরেছে অরিত্র | কফি কাপটা পালকের দিকে হাসিমুখে এগিয়ে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা সকালের খবরের কাগজটার দিকে চোখ বোলাতে লাগলো সে |
Day: 25 December, 2015
আজ সকাল থেকে খুব ব্যস্ত পালক | পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যপারে বরাবর খুব খুঁতখুঁতে ও | ছুটির দিন পেলেই নিজের হাতে ঘরগুলো পরিষ্কার করতে থাকে সব | এই বাড়িতে স্টাডি রুমটা হলো ওর সবচেয়ে প্রিয় ঘর | সেই সকাল থেকে আলমারিতে রাখা বইগুলো বার করে টেবিলের ওপর রেখে আলমারির ভেতরটা পরিষ্কার করছে আর নিজের পছন্দের বইগুলোর এক একটা পাতা মাঝে মাঝে উল্টে পড়ে নিচ্ছে | বই পড়া ওর কাছে একটা নেশা | সারাদিন সে যতই ব্যস্ত থাকুক, রোজ অন্তত একটা পাতা না উল্টে দেখলে তার ঘুম আসেনা | অরিত্র যদিও একটা Kindle কিনে দিয়েছে তাকে, কিন্তু বই হাতে নিয়ে পড়ার সেই আনন্দ, বইয়ের পাতার গন্ধ – Kindle, e-book এ সেসব আছে কোথায়?
জওহরলাল নেহরুর লেখা “Letters From a Father to His Daughter” বইটা সরাতেই পালকের চোখে পড়ল তার বাবার পুরানো টাইপরাইটার | টাইপরাইটারটা দেখে খুশিতে ঝলমল করে উঠলো তার চোখ | খুব অবাক লাগলো যে ওটা এতদিন খেয়ালই করেনি | আলমারির এক কোনে ওটা পড়েছিল | খুব যত্ন করে নামিয়ে টেবিলের ওপর রাখলো ওটাকে | শৈশবের কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই টাইপরাইটারটার সাথে ! ছোটবেলায় বাবা যখন খটখট শব্দ করে টাইপরাইটারে লিখতো, এক মুহূর্তের জন্যও বাবার কাছ থেকে উঠতে মন চাইতো না | এই খটখট আওয়াজ করে একটা সাদা পাতায় নিজের মনের মতো অক্ষরগুলোকে একের পর এক ছাপতে দেখে খুব মজা পেত ও | সত্যি শৈশবটা এতো মজার আর এতো অদভূত হয় , কত ছোটো ছোটো জিনিসে কত খুশি হয়ে যায় মন, যেগুলো বড় হয়ে আর থাকে না | অরিত্রর গলা খাকরানির আওয়াজে সম্বিত ফিরে পেলো সে | টাইপরাইটারটা দেখে নিজের শৈশবের স্মৃতিচারণে মগ্ন হয়ে সময়ের কথা ভুলেই গিয়েছিল |
অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বললো, “জীবন কত দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে, না? আজকাল আর কেও টাইপরাইটার ব্যবহার করে না | অথচ জানো, ছোটবেলায় আমার বেশ লাগতো এই টাইপরাইটারে টাইপ করতে দেখতে |”
অরিত্র হেসে বললো, “না পাল্টালে আমরা এগোবো কি করে ? এখন তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করো, বিকেলে Christmas party আছে |”
পার্টি থেকে ফিরে এসে রাতে শুতে যাওয়ার সময় পালক দেখলো বেড টেবিলের ওপর রাখা আছে রঙিন কাগজে মোড়া একটা বাক্স | হাতে তুলতেই দেখলো লেখা আছে, “Merry Christmas – From Aritra (Your Santa )” |
খুশি হয়ে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বললো, “থ্যাংক ইউ ! কি আছে এটাতে?”
অরিত্র হাসতে হাসতে বললো, “সেটা বলা যাবে না | তুমি নিজে খুলে দেখো | “
পালক খুশিতে gift wrap টা খুলে দেখে টাইপরাইটারের একটা ইন্কসেট | ওর মনে আছে বাবা সেটাকে রিবন বলতো |
অবাক হয়ে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বললো ,”টাইপরাইটারের ইন্কসেট? কি করবো এটা নিয়ে? “অরিত্র বললো, “লিখবে |”
“টাইপরাইটারে লেখা? এখন আবার কেও লেখে টাইপরাইটারে? আজকাল যে টাইপরাইটারের কালি কিনতে পাওয়া যায় সেটাই তো জানতাম না ! “
“কেও লেখে না তো কি হয়েছে? তুমি লিখবে | তোমার তো টাইপরাইটারের টাইপিং এর খটখট আওয়াজটা খুব ভালো লাগে | “
সত্যি অরিত্রটা না একদম পাগল, নিজের মনেই বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো পালক |
Day: 27 December, 2015
আজ রবিবার | অরিত্র এর মধ্যে টাইপরাইটারটা একদম ঠিক করে দিয়েছে | বহুদিন অব্যবহৃত অবস্থায় ওটা পড়ে ছিল | আনমনে দুপুরবেলায় টাইপরাইটারটা নিয়ে লেখা শুরু করলো পালক | প্রথমে আস্তে আস্তে তারপর একটু দ্রুত গতিতে একের পর এক পাতা টাইপ করতে লাগলো সে | কত অজানা কথা বলার থাকে নিজের মনে, সবকিছুই যেন লিপিবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে টাইপরাইটারের সৌজন্যে |
*********************************************************
Day: 25 December , 2016
টিংটং, ঘরে কলিং বেলটা বেজে উঠলো | দরজা খুলে পালক দেখলো একটা ডেলিভারি বয়, হাতে একটা ফুলের bouquet আর একটা সবুজ রঙের gift wrap এ মোড়া কিছু একটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে |
“Good morning mam ! Merry Christmas !”
“থ্যাংক ইউ” বলে গিফটটা হাতে নিয়ে পালক দেখে কার্ড এ লেখা আছে “Merry Christmas – From Aritra (Your Santa ) ”
পালক গিফটটা হাতে নিয়ে অরিত্রর দিকে চেয়ে বললো , “এটা কি নতুন ধরনের পাগলামো অরিত্র? আমি তো আজ বাড়িতেই আছি | তুমি তো আমাকে বাড়িতেই গিফট টা দিতে পারতে |”
অরিত্র হেসে পালকের কাছে এসে বললো, “Gift wrap টা খোলো আগে !”
“কি আছে এটাতে? বই মনে হচ্ছে? উফফ, না জানিয়ে আমার জন্য বই কিনতে গেলে কেন? জানো তো তোমার আর আমার পড়ার taste সম্পূর্ণ আলাদা | যদি আমার ভালো না লাগে?”
“আরে, একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে দিলে ! আগে দেখ কি আছে ? ট্রাস্ট মি ! ভালো লাগবে | “
পালক আর কথা না বাড়িয়ে gift wrap টা খুলে দেখল, নীল কভারে মোড়া একটা বই, তাতে জ্বলজ্বল করছে কতগুলো অক্ষর – “A Pocketful of Life – Author Palok Biswas, Published by Penguin” |
খুব ইচ্ছে ছিল নিজের জীবনের মুহূর্তগুলোকে একটা গল্পের আকারে লিখতে | এতদিন সে টাইপরাইটারে সেই মুহূর্তগুলোকে লিখে গেছে | এই চার মাস আগে গল্পটাও শেষ হয়েছে | তারপর থেকে টাইপরাইটারটা নিয়ে আর বসা হয়নি | ও জানতোও না অরিত্র কখন তার লেখা নিয়ে একটা বই publish করেছে |
চোখ ছলছল করে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললো , “এটা কি?”
অরিত্র ছোট্ট একটা হাসি হেসে বললো, “Surprise Gift !”